1. [email protected] : admi2018 :
April 19, 2024, 3:23 pm

আন্দোলন দমনে শক্তির প্রয়োগ হবে বড় ভুল

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম Sunday, August 5, 2018
  • 1138 বার পঠিত

কোনো আন্দোলনের সূচনা ঘোষণা দিয়ে সংঘটিত হয় না, আন্দোলনের প্রথম এবং প্রধান শর্ত হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ততা। সেই প্রতিবাদই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়, যার কারণ ও দাবিদাওয়া নাগরিকদের জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে নাগরিকদের কাছে প্রতীয়মান হয়। যেসব ঘটনা অন্য সময়ে সাধারণ ও স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়, তা কেবল তখনই আন্দোলনের উপাদানে পরিণত হতে পারে, যখন তা একটি প্রতীকী বিষয়ে পরিণত হয়। আরও ব্যাপক কিছুর প্রতীক-সূচনাকারী সুনির্দিষ্ট ঘটনা তখন কেবল উপলক্ষ। পৃথিবীর যেকোনো আন্দোলনের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলেই তা বোধগম্য।

যাঁরা বাংলাদেশের ইতিহাস, বিশেষ করে আন্দোলনের ইতিহাস ঘনিষ্ঠভাবে জানেন, তাঁরা নিশ্চয় এ বক্তব্যের পক্ষে অসংখ্য উদাহরণ দিতে পারবেন। এটাও সবাই জ্ঞাত যে সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রধান শক্তি হয় তরুণেরা। এটি একটি কারণ অবশ্যই যে তাদের কর্মশক্তি (এনার্জি) অন্যদের চেয়ে বেশি; কিন্তু তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, যেকোনো আন্দোলনের লক্ষ্যই হচ্ছে বিরাজমান অবস্থার পরিবর্তন, অন্য রকম ভবিষ্যৎ তৈরি করা। গত রোববার থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে তরুণ শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে, তা বোঝার জন্য এসব বহু-চর্চিত কথাগুলো আমাদের স্মরণে রাখা দরকার।

এ আন্দোলনের সূত্রপাত রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে গত রোববার বাসচাপায় নিহত শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজীবের মৃত্যুর ঘটনায়। বাসের চাপায় যেভাবে তাঁদের মৃত্যু ঘটেছে, তা বিরল ঘটনা নয়। আসলে বাংলাদেশের সড়কপথে অপঘাতে মৃত্যু এতটাই স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে যে এগুলো এখন কার্যত পরিসংখ্যানের চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু সেই প্রেক্ষাপটে মিম ও রাজীবের সহপাঠীরা যে প্রতিবাদের সূচনা করেছিল, তা যে একটি আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে, তার কারণ কী?

অন্যতম কারণ হচ্ছে, এই শিক্ষার্থীরা দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতায় উপলব্ধি করেছে যে গোটা পরিবহনব্যবস্থার মধ্যেই একধরনের দায়িত্বহীনতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার উপস্থিত। জবাবদিহির অনুপস্থিতি যে এই খাতের কত গভীরে প্রোথিত, সেটা আমরা কাগজে-কলমে, তথ্য-উপাত্তে জানলেও তার মাত্রা ও চেহারা গত পাঁচ দিনে যেভাবে নগ্ন হয়ে ধরা পড়েছে, তা আমরা জানতাম-এমন দাবি করা যাবে না।

এ প্রতিবাদ প্রচলিত প্রতিবাদের ধরন থেকে আলাদা হয়ে গেছে এ কারণে যে শিক্ষার্থীরা বিরাজমান ব্যবস্থার ত্রুটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি করণীয় কী, সেটাও তুলে ধরেছে। এ আন্দোলনের ক্ষেত্রে মিম ও রাজীবের মৃত্যু সূচনাকারী ঘটনা, কিন্তু তার মর্মবস্তু হচ্ছে জবাবদিহির দাবি।

গত কয়েক দিনে সরকারি মহলের প্রতিক্রিয়ায় এটা স্পষ্ট যে তাঁরা বুঝতেই অনীহ এ দাবির পেছনে কী ধরনের মনোভাব কাজ করছে। তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় যে তাঁরা বারবার শিক্ষার্থীদের আবেগের কথাকেই বড় করে দেখানোর চেষ্টা করছেন, সেটা অনিচ্ছাকৃত নয়, তাঁদের মানবিকতা চর্চার বিষয়ও নয়। এটা করা হচ্ছে, কেননা তাঁরা এ আন্দোলনকে ‘আবেগের বহিঃপ্রকাশ’ এবং ‘এসব দাবি সাময়িক উত্তেজনার ফসল’ বলে প্রতিষ্ঠা করতেই উৎসাহী। তাতে করে এ শিক্ষার্থীরা যখন রাজপথ থেকে ফিরে যাবে, তখন এটা বলা সম্ভব হবে, আবেগের বশে তাঁরা যা বলেছেন তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। একধরনের গোঁজামিলের হিসাব তৈরি করে, পুরোনো ব্যবস্থায় যৎকিঞ্চিৎ প্রসাধনী লাগিয়ে তাকে বহাল রাখাই হবে ক্ষমতাসীনদের লক্ষ্য। আমার এ আশঙ্কার কারণ বোঝার জন্য সাম্প্রতিক কালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ব্যাপারে সরকারি ভাষ্য ও গৃহীত ব্যবস্থার কথা স্মরণ করতে পারেন।

পরিবহন সেক্টরের সমস্যা জটিল, এক দিনের নয়। এক দিনে সমাধান করা যাবে না, এর জন্য আইন বদল করা দরকার, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে-এসব কথা সহজেই গ্রহণযোগ্য। কেননা, এগুলোর মধ্যে সত্যতা আছে, কিন্তু সেই সত্যতা আংশিক মাত্র। এগুলো বলার আরেক কারণ হচ্ছে, পরিবহন সেক্টরের এই নৈরাজ্যিক পরিস্থিতির রাজনৈতিক-অর্থনীতি আড়াল করা। এই রাজনৈতিক-অর্থনীতির প্রধান উপাদান হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার (প্রথম আলো, ‘পরিবহন খাত মন্ত্রী, সাংসদসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের কবজায়, ’ আগস্ট ২,২০১৮)।

এ খাতে ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্য এবং মালিক ও ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে শ্রমিকদের ব্যবহারের যে ঐতিহ্য তৈরি করা হয়েছে, সেটি বহাল রেখে কী করে অন্য জটিলতা মোকাবিলা করা সম্ভব, তা কেউই বলছেন না। এই রাজনৈতিক-অর্থনীতি কি শুধু পরিবহন খাতেই বিরাজমান? অবশ্যই তা নয়। আপনার চারদিকে তাকালেই যেকোনো খাতের দিকে লক্ষ করলেই তা সহজে বুঝতে পারবেন। সম্ভবত ব্যাংকিং খাত হচ্ছে এর জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু মনে রাখবেন, সেটা একমাত্র উদাহরণ নয়। যাঁরা এ আন্দোলনের মধ্যে জবাবদিহির প্রশ্নটিকে দেখতে চাইছেন না, তাঁরা ইচ্ছে করেই তা চাইছেন না। যেখানে গোটা ব্যবস্থাকেই জবাবদিহিহীন করে ফেলা হয়েছে, সেখানে এ প্রশ্ন একবার উত্থাপিত হলে তা কেবল একটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দায়মুক্তির এক অবাধ ব্যবস্থা। তার প্রমাণ হচ্ছে, ঢাকার রাস্তায় গত পাঁচ দিনে যত চালকের লাইসেন্স না থাকার, যত গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট না থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের কারণে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া আপনি গাড়ি চালালেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং কর্তৃপক্ষ কিছু করবে না।

এ আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং অংশগ্রহণকারীদের পরিচয় হচ্ছে তারা স্কুল এবং কলেজের শিক্ষার্থী। অতীতে আমরা যে বয়সের তরুণদের আন্দোলনের অগ্রভাগে দেখে অভ্যস্ত, সেই তুলনায় এ আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীরা বয়সে কম। তাদের ভূমিকার প্রশ্নে এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, সেটা যদি এই কারণে বলা হয় যে অন্যদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণেই তাদের এ ভূমিকা নিয়ে হয়েছে-তবে সেটা বোধগম্য। কিন্তু এ কথা বলার সময়ে আমাদের মনে রাখতে হবে যে এ আন্দোলনের দাবি শিশুদের দাবি নয়, তারা স্কুল বা কলেজের ক্যানটিনের খাবারের মান নিয়ে আন্দোলন করছে না; নাগরিক হিসেবে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা ও শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার দাবি নাগরিকের দাবি বলেই তারা পথে নেমে এসেছে। সেভাবে বিবেচনা না করলে এ আন্দোলনকে ভুল কারণে ‘ঐতিহাসিক’ বলে মনে হবে।

যাঁরা বারবার বলেছেন এরাই ভবিষ্যৎ, তাঁরা সম্ভবত বিস্মৃত হচ্ছেন যে তাদের সংগ্রাম এ সময়ের বাংলাদেশকে বদলে দেওয়ার-আগামীর জন্য অপেক্ষা করার নয়। ২০১৮ সালের বাংলাদেশে নাগরিকের যে অধিকার নিশ্চিত হওয়ার কথা ছিল, তা না থাকার কারণেই তারা এখন পথে নেমেছে। এটা বুঝতে না পারলে তাদের প্রতি হয়তো মমত্ববোধ প্রদর্শিত হবে, কিন্তু তাদের দাবি যে নাগরিক হিসেবে আপনারও দাবি, আপনি যে সেই বিবেচনায়ই এ আন্দোলনের পক্ষে, তা প্রমাণিত হয় না। এর সাফল্যের যেমন আপনি ভাগীদার হবেন, তেমনি এ আন্দোলনের পরেও যদি স্থিতাবস্থা ফিরে আসে, তবে তার দায় আপনারও।

যেকোনো আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৈরি হয়, তার পরিণতি পূর্বনির্ধারিত নয়। আন্দোলনকারীরা কতটা অর্জন করে বাড়ি ফিরবে, সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু এ আন্দোলনকে শক্তি দিয়ে দমন করার যে লক্ষণ গতকাল (শনিবার) ধানমন্ডি ও জিগাতলায় লক্ষ করা গেল, সেটাই যদি সরকারের নীতি হয়ে থাকে, তবে তা হবে বড় ভুল। আন্দোলনকারীরা নতুন পথ এবং নতুন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে, তাকে পুরোনো কৌশলে মোকাবিলা করার পথে যাঁরা হাঁটছেন, তাঁদের বিবেচনায় রাখা দরকার যে এ আন্দোলনের প্রধান দুটি স্লোগান হচ্ছে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ (আমরা ন্যায়বিচার চাই) এবং ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তুমি বাংলাদেশ।’

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
© All rights reserved © 2019 TV Site
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
themesbazar_newssitedesign