বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রবর্তিত তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাটি একটি কালাকানুন হিসেবে চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার এটি টানা প্রায় নয় বছর ব্যবহার করার পর এখন প্রস্তাবিত ডিজিটাল আইনে তার অদলবদল করেছে। আমরা এতে বিস্মিত, ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। যদিও আমরা ক্রমবর্ধমান সাইবার অপরাধ দমন ও প্রতিরোধে উপযুক্ত আইন থাকার পক্ষে। সরকার আবারও প্রমাণ করল, তারা কত সহজেই জনমত উপেক্ষা করতে পারে। খসড়া ডিজিটাল আইনের যে প্রায় অর্ধডজন ধারা সম্পর্কে গণমাধ্যম, বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তরফে আপত্তি ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল, তার সবই অপরিবর্তিত রেখে সোমবার জাতীয় সংসদে বিল আকারে তা পেশ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বিল পাস হলে তা বাক্স্বাধীনতা এবং সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার প্রতি নতুন করে হুমকি সৃষ্টি করবে।
প্রস্তাবিত আইনের যেসব দিক আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে, তার মধ্যে তিনটি বিষয় জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় গুরুতর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে প্রতীয়মান হয়। এক. এমন অনেক নতুন অপরাধ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। যেমন মানহানির সংজ্ঞা ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী আমরা বুঝব। কিন্তু অন্য অনেক অপরাধ এতটাই অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থক যে তা অপব্যবহারের পথ খুলে দেবে। এই বিল একটি অধিকতর পুলিশি রাষ্ট্রের বিপদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ‘দেখিলে শুনিলে নীতিভ্রষ্ট’ হওয়ার মতো অপরাধের অস্পষ্ট পরিভাষা নিয়ে নাগরিক সমাজের তীব্র আপত্তি ও প্রতিবাদ ছিল। বিশেষ করে, গত কয়েক বছরে এসব বিষয়ে অনেক সভা-সেমিনার হয়েছে এবং আইনমন্ত্রী এসব কালাকানুন বাতিলের অঙ্গীকার করেছিলেন। দুই. ফৌজদারি আইনের আওতায় নৃশংস অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে দণ্ডবিধিতে যে শাস্তির পরিমাণ স্থির করা আছে, শাস্তির সেই অনুপাতের তুলনায় ডিজিটাল আইনের আওতায় জেল ও জরিমানার পরিমাণ বহু গুণ বাড়ানো হয়েছে। তিন. আদালতে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলেও প্রচলিত দণ্ডবিধির আওতায় শাস্তির মাত্রা নির্ধারণে বিচারকের স্বাধীনতা অবারিত রাখা আছে। যেমন দণ্ডবিধিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারাদণ্ডের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়া আছে। জরিমানার টাকার অঙ্ক বেঁধে দেওয়া নেই। কিন্তু ডিজিটাল আইনে ন্যূনতম কারাদণ্ড ও জরিমানার টাকা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ফসল যে বাহাত্তরের সংবিধান, তার ৩৯ অনুচ্ছেদে সংসদকে বাক্স্বাধীনতা হরণকারী আইন তৈরি করার এখতিয়ার দেওয়া হয়নি। বরং সংসদ যাতে যা খুশি তা-ই করতে না পারে, সে জন্য শর্ত দেওয়া হয়েছে যে সংসদকে অবশ্যই যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে আইন করতে হবে। গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, বাক্ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক কাঠামোগুলোর মধ্যে সর্বাধিক মৌলিক। শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফাসহ তাঁর সব কর্মসূচিকে বাংলার জনগণের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিতে সাংবাদিকেরা অকুতোভয় ছিলেন। সেই সাহস ও ঐতিহ্যকে স্বীকার করতেই সংবিধানে বাক্স্বাধীনতার বাইরে সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতাকে আলাদা স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, সে কারণে এ রকম অনুচ্ছেদ উপমহাদেশের অন্য কোনো সংবিধানে নেই।