1. [email protected] : admi2017 :
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৪৭ অপরাহ্ন

অনাদর্শিক বাস্তববাদ

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
  • ৮৪০ বার
অনাদর্শিক বাস্তববাদ

রোহিঙ্গা সংকটটি ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে। এই সংকটের একটি দিক, এই বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুকে থাকতে দেওয়া, তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু তার চেয়ে বেশি বড় চ্যালেঞ্জ এদের রোহিঙ্গা পরিচয়ে মিয়ানমারের ফেরত পাঠানো। যদি না যায়, যেমন যায়নি এর আগেও, তাহলে এই জন্মদানে উর্বর এই বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের অধিবাসীর অধিকারেরই দাবিদার হয়ে উঠবে। এটি আশংকা শুধু নয়, অনিবার্য। এত সংখ্যক নূতন অধিবাসীর চাপ নেয়ার জায়গা কি আছে আমাদের? প্রশ্নটি অর্থনৈতিক-সামাজিক সঙ্গতির যেমন, তেমনি নিরাপত্তারও। রোহিঙ্গাদের মধ্যে কোনও জঙ্গি সংযোগ আছে কি না, তা এখনও নিশ্চিত রূপে প্রমাণিত নয়। কিন্তু রোহিঙ্গার মধ্যে সেই সংযোগ থাকবেনা, বা তৈরি হবেনা তাও বলা যাচ্ছেনা।

তবে রোহিঙ্গা সংকটের অন্য দিকটিও বিষম জটিল: তিন অতি নিকট প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রক্ষার তাগিদ। ভারত ও মায়ানমার আমাদের নিকট প্রতিবেশি। চীনও কাছের বন্ধু। মিয়ানমারের সাথে কূটনৈতিক অংক কখনো মিলেনি। কিন্তু যাদের সাথে মিলেছে বলে আমরা জানতাম, সেখানেও হোঁচট খেতে হয়েছে কিছুটা। মায়ানমার প্রশ্নে ভারত ও চীন যেভাবে বর্মীদের পিঠ চাপড়িয়েছে তাতে মিয়ানমার এখনও অবধি তাদের পরমপ্রীত। ঢাকার প্রচেষ্টায় কিছুটা অবস্থান বদলেছে ভারত, তবে চীন এখনো মিয়ানমারেরই পাশেই থাকলো। বাংলাদেশের পক্ষে থাকার বিষয় নয়, কারণ বিষয়টি বাংলাদেশের নয়। বাংলাদেশ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এক সমস্যার শিকার। দুঃখজনক হলো, চীন মানবতার পক্ষে সামান্য অবস্থানও নিলনা।

‘শুরু থেকে মিয়ানমার বিশ্বকে তোয়াক্কা না করে মিথ্যা বলে যাচ্ছে, গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিশ্ব বিবেক নিরব।’

তাই এখন বন্ধু দেশ সমূহের সমালোচনা হচ্ছে। তবে সমালোচনা করলেই সেটা শত্রুতা হয়ে যায় না। বাংলাদেশের পরীক্ষা এখন অনেক। একদিকে, ১০ লাখ বিপর্যস্ত হত দরিদ্র উদ্বাস্তুকে ব্যবস্থাপনায় রাখা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনীতি বজায় রাখা। বলতে গেলে আমাদের কূটনীতির সবচেয়ে বড় পরীক্ষায় আজ দেশ উপনীত। বিপদের দিনের বন্ধু দেশ খোঁজার এক নতুন প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ। এসেছে ১৯৭৮, ১৯৯২, ২০১২-এ এবং আবার ২০১৭-তে দলে দলে রোহিঙ্গারা এসে ভরে গেলো কক্সবাজার। মিয়ানমার রোহিঙ্গা জনগ্রষ্ঠিকে নির্মূল করতে চায় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে গণহত্যা শুরু করেছে।

প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ কতদিন এদের রাখবে? এই সমস্যা কি শুধুই বাংলাদেশের, নাকি সভ্য দুনিয়ারও? এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে জাতিসংঘ মহাসচিব। তিনি বলেছেন, দায় মিয়ানমারের, সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব পৃথিবীর। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও অং সাং সু চির সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। বুধবার, আমেরিকার ভাইস-প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স জানান, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করতে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আরজি জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প৷ শুধু তাই নয় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ‘কঠোর’ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানান তিনি৷ রাখাইন প্রদেশে চলা রোহিঙ্গা ‘গণহত্যা’র প্রতিবাদে সরব গোটা বিশ্ব৷ তবে এপর্যন্ত মৌন ছিল আমেরিকা৷ অনকেই অভিযোগ তুলেছেন ট্রাম্প মুসলিম বিদ্বেষী৷ তাই শরণার্থী সমস্যা নিয়ে মুখ খুলছেন না তিনি৷ এবার সেই অভিযোগ উড়িয়ে মিয়ানমারকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট৷ রাখাইন প্রদেশে চলা হিংসা আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড়সড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তিনি।

মিয়ানমারের উপর চাপ হয়তো আরো দেশ ও ব্যক্তি থেকে আসবে। কিন্তু এই সমস্যা বাংলাদেশ শিক্ষা দিল যে, কূটনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু দেশ নেই। রাশিয়া, চীন, ভারত সবাই বাণিজ্যিক হিসেব করেছে বন্ধুতার পরিবর্তে। নিরস্ত্র, নিরন্ন, হতদরিদ্র রোহিঙ্গা শিশুর রক্তের বন্যায় নাফ নদী ভেসে গেলেও, সমান্যতম তার প্রভাব পড়েনি তাদের হৃদয়ে।

শুরু থেকে মিয়ানমার বিশ্বকে তোয়াক্কা না করে মিথ্যা বলে যাচ্ছে, গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিশ্ব বিবেক নিরব। আমরা দেখেছি, মিয়ানমারের সামরিক সরকার যখন বিদ্রোহীদের উপর প্রবল দমন নীতি চালাচ্ছিল, গণতন্ত্রকামীদের উপর এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ উঠছিল বিশ্ব জুড়ে, চীন কোন কৌশলেরও আশ্রয় নেয়নি, বরং সরাসরি অত্যাচারীর পক্ষ নিয়েছে। ভারতও প্রায় কাছাকাছি দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিল। চীন সঙ্গি করলো রাশিয়াকেও। সুতরাং এখন আমাদের বিশ্ব রাজনীতি তাহলে কি দাঁড়ালো? বাস্তববাদ? এই বাস্তববাদকেই এখন আমাদের কূটনীতির প্রধান দর্শন বলে মানতে হবে। এ এক নতুন অনাদর্শবাদ।

গোটা দুনিয়ার পররাষ্ট্র দর্শনই বাস্তববাদকে বেছে নিয়েছে, বিশেষত গত দশকের সেই ইরাক যুদ্ধের পর। অন্যান্য রাষ্ট্রের চরিত্র পাল্টানো পররাষ্ট্র নীতির কাজ নয়, অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ‘ম্যানেজ’ করাটাই কাজ। বাংলাদেশের কাঁধে সেই বাস্তববাদ-এর ভার। অর্থনৈতিক স্বার্থে দুনিয়া যদি নৈতিকতার বদলায় তবে বাংলাদেশেও বদলে ফেলুক। শ্যাম ও কুল বজায় রেখে মধ্যমপন্থায হাঁটার দিন শেষ হয়ে এলো। কোনটায় আমার লাভ বেশি নির্ণয় করা এবং সেই অবধি হেঁটে যাওয়ার সাহস থাকাটাই জরুরি। নীতি তৈরির সময় স্বার্থের দিকে মনোযোগ দেওয়ার অর্থ নীতি থেকে আত্মপ্রত্যয়টাকে ছেঁটে বাদ দেওয়া নিশ্চয় নয়। বাস্তববাদ হয়ে বন্ধুতার সমালোচনা হোক আরও বাস্তব ভাবে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..