নায়কের বন্ধুকে সিনেমা শেষে কেউ মনে রাখেনা। নায়করাজ রাজ্জাককে সবাই চেনে। তাঁর মৃত্যুতে সব পত্রিকায় বড় শিরোনাম হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ আজীবন মনে রাখবে তাঁকে। কিন্তু সিনেমায় রাজ্জাকের বন্ধু আলতাফ কিংবা খান জয়নুলের কথা কারো মনে আছে? বেশিরভাগেরই নেই। কারণ তারা তো রাজ্জাকের মতো রূপবান পুরুষ নয়! তাদের কোন বিশেষ গুণও থাকে না। নায়ক যেমন গান গাইতে পারে, নাচতে পারে, মারামারি করতে পারে, বন্ধু কোন কিছুই পারেনা। তবে বিশেষ বিশেষ দৃশ্যে হাস্যরসের যোগান দিতে পারে কখনও কখনও।
আপনি যদি বাংলা কিংবা হিন্দি সিনেমার নিয়মিত দর্শক হন, তাহলে বিষয়টা আপনার চোখে হয়ত আগেই পড়েছে। সিনেমা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নায়কের বন্ধুর উপস্থিতি থাকলেও তার নাম ট্রেলারে লেখা হয় না (অনেক সময় নায়িকার চেয়ে তাকে পর্দায় বেশি সময় দেখানো হয়)। তার ভূমিকা অনেক সময় কৌতুক অভিনেতার মতো। সুসময়ে সে সবাইকে হাসায়। আবার দুঃসময়ে নায়কের পাশে আর কেউ না হোক সে থাকে। গোরস্থানে কিংবা শ্মশানে, জানাজায় কিংবা অন্তেষ্টিক্রিয়ায় নায়কের পাশে একমাত্র বন্ধুই দাঁড়ায়।
‘বাস্তবে সঠিক ভালো বন্ধু পাওয়া সত্যি কঠিন। বিশেষ করে নায়কের বন্ধুর মতো বন্ধু! সিনেমার নায়কের মতো তার বন্ধুও যেন একটি কাল্পনিক চরিত্র।’
নায়ক কখনও ভুল পথে গেলে সেই বন্ধু থাকে তাকে ফিরিয়ে আনে। তখন সে যাত্রা দলের বিবেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সত্যি কথা বলতে সে একবিন্দু ছাড় দেয় না। মোহ আর প্রলোভনে অন্ধ হয়ে নায়ক অনেক সময় ভুল পথে পা বাড়ায়। বন্ধু কিন্তু নায়কের সঙ্গী হয় না। বরং সে চোখে আঙ্গুল দিয়ে নায়কের ভুল ধরিয়ে দেয়। প্রথম অবস্থাতে নায়ক সেটা সহ্য করতে না পেরে বন্ধুকে ত্যাগ করে। কিন্তু পরে ভুল বুঝতে পেরে বন্ধুর কাছে ক্ষমা যায়। আর যত বড় ভুল করুক না কেন বন্ধু কিন্তু ঠিকই নায়ককে ক্ষমা করে বুকে জড়িয়ে ধরে।
বাস্তবে এই উদারতা আমরা কতখানি দেখাতে পারি? আসলেই কি পারি? বন্ধু ভুল করার পওে, আবার অনুতপ্ত হয়ে ফিরে এলে, আমরা কি পারি তাকে বুকে টেনে নিতে? সে কোন মারাত্মক অপরাধ করলে পারি তাকে সমর্থন দিতে? যেমন ধরুন, আপনার বন্ধু যদি কোন ঘটনার ফেরে কোন খুন করে বসে, এবং আপনার কাছে আশ্রয় চায়, তবে কি পারবেন সেই বন্ধুকে আশ্রয় দিতে? নায়কের বন্ধু কিন্তু এই কাজটা সব সময় করে। সে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও করে। সিনেমা শেষে দেখা যায় বন্ধু মারা যায়, কিন্তু নায়ক বেঁচে থাকে। নায়ক চোখের জলে বন্ধুকে স্মরণ করে। কিংবা অনেক সময় অনাগত সন্তানের নাম রাখে।
বন্ধুত্ব জিনিসটাই এমন যে তাকে কোন সরল সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। মানুষের বন্ধু এক বা একাধিক থাকতে পারে। বন্ধু নানা বয়সের হতে পারে। যে কোন লিঙ্গের হতে পারে। তবে নায়কের বন্ধু বেশিরভাগ সময় তার সহপাঠি থাকে। নায়কের মতো বন্ধুও অনেক সময় প্রেমে পড়ে। তবে নায়কের প্রেমে যেমন অনেক বেশি উত্থান-পতন থাকে, বন্ধুর প্রেমে সেটা থাকেনা। নায়কের বন্ধুর প্রেম একদম মসৃণ। নায়কের বন্ধুর আসলে জীবনে কোন সমস্যাই থাকে না। তার যত চিন্তা নায়ককে ঘিরে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, নায়কের বন্ধু আসলেই কি আলাদা কোন মানুষ? নাকি নায়কেরই দ্বিতীয় সত্তা। যার নিজের সুখ-দুঃখ বলে কিছু নেই। কোন ব্যক্তিগত জীবন নেই। তার কাজ শুধু নায়ককে অনুসরণ করা। বিনা প্রশ্নে নায়কের জীবনের চ্যালেঞ্জকে নিজের জীবনের চ্যালেঞ্জ করা। বাস্তবে তো সিনেমার মতো এমন বন্ধু মেলে না, তাই এই প্রশ্ন। তবে বাস্তবে তো নায়কের মতো সর্বগুণান্বিত মানুষও মেলেনা।
চাঁদ সওদাগরের পালায় চাঁদ বেনের বন্ধু শিব দাসের কথা মনে আছে? যে বিনা যুক্তিতে চাঁদের সমস্ত সিদ্ধান্ত মেনে নিত। বাণিজ্য করতে গিয়ে সমুদ্রে যখন ঝড় ওঠে, তখন সমস্ত সঙ্গীরা বিদ্রোহ করে চাঁদ সওদাগরের বিরুদ্ধে, কিন্তু একমাত্র শিবদাস ছিল বন্ধুর প্রতি আস্থায় অটল। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে সাহসী নায়ক আর কে আছে চাঁদ সওদাগরের মতো। তার বন্ধু শিবদাসের মতো প্রাচীন ধ্রুপদী কাহিনীতে এমন অনেক বন্ধুর দৃষ্টান্ত মিলবে, যারা আমৃত্যু ছায়ার মতো থাকে নায়কের!
সাধারণ ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারাই বন্ধু হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে হতে পারে শৈশবে খেলার সঙ্গী। কোচিং সেন্টার কিংবা প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়তে গিয়েও বন্ধুত্ব হয়। কোন সংগঠন করতে গিয়ে বন্ধু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একই বাসে যেতাম, তেমন সঙ্গীদের সাথেও আমার বন্ধুত্ব হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে বন্ধুত্ব হয়। এছাড়াও নানাভাবে একজনের সঙ্গে অন্যজনের বন্ধুত্ব হতে পারে।
মাঝবয়সে এসেও নতুন বন্ধু পায় অনেক সময় মানুষ। যেমন সন্তানের বন্ধুর মাও অনেক সময় দারুণ বন্ধু হয়ে যায় অন্য মায়ের। নিউ ইয়র্কে যেটা আমি পেয়েছি। তদুপুরি লেখালেখির সুবাদে পেয়েছি আরও অনেক অনেক বন্ধু। আসলে বন্ধুত্ব রক্ষা করতে কিছু উপলক্ষ লাগে। নয়ত চোখের আড়াল হতে হতে অনেক সময় মনের আড়াল হয়ে যায়।
আগেই বলেছি, নিউ ইয়র্ক শহরে এসে আমি অনেক বন্ধু পেয়েছি। যদিও এই মুহূর্তে আমাকে একজন আদর্শ বন্ধু বলা যাবে না! কারো এক ডাকে আমি ছুটে যেতে পারিনা। জীবনের নানা সীমাবদ্ধতা আমাকে সেটা হতে দেয়না। তবে চেষ্টা থাকে কারো উপকার করতে না পারলে অপকার না করার।
এই শহরে অনেককে দেখি আজ সকালে পরিচয়, দুপুরেই সে জানের জান বন্ধু, রাতেই আবার মুখ দেখাদেখি বন্ধ, এমনতর বন্ধুত্ব নিশ্চয়ই কারো কাম্য নয়। বন্ধুত্বে একজন অপরজনকে সমানভাবে মর্যাদা দিতে হয়। কেউ যদি দয়া করে কাউকে বন্ধু করে, নিজেকে বন্ধুর তুলনায় শ্রেয়তর ভাবে, তবে শুরুতেই সেই সম্পর্কে পচন ধরে!
বন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ততা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কখনও যদি পারিপার্শ্বিকতার চাপে কিংবা কোন ভুলা বোঝাবুঝির কারণে বন্ধুত্ব ভেঙে যায়, তবে দেখি কেউ কেউ বন্ধুর গোপণ কথা ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দেয়! যে এই ধরনের হুমকি দেয়, তাকে আড়ালে যে সবাই অপছন্দ করে, এটা তাকে বুঝতে হবে। তখন অন্য বন্ধুও তার ওপর আস্থা হারাতে শুরু করে। বন্ধুর সাফল্যে ঈর্ষা করা, বন্ধুর দুর্বলতা নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করা, বন্ধুকে সবার সামনে হেয় করা, বিভিন্ন ইস্যুতে বন্ধুর পক্ষ না নেয়া- অবশ্যই প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় নয়।
বাস্তবে সঠিক ভালো বন্ধু পাওয়া সত্যি কঠিন। বিশেষ করে নায়কের বন্ধুর মতো বন্ধু! সিনেমার নায়কের মতো তার বন্ধুও যেন একটি কাল্পনিক চরিত্র। এমন আদর্শ বন্ধু যেন কল্পনাতেই থাকে।
Leave a Reply