রোদেলা দুপুর। ঢাকা যাবো বলে রফরফ লঞ্চে বসে আছি। বিরাটাকায় লঞ্চ, যেন আগের দিনের স্টিমার। লঞ্চে বসে থেকে টার্মিনালে মানুষের আনাগোনা, হৈ-হুল্লোড় উপভোগ করছি। কেউ বিদায় নিচ্ছে, কেউবা বিদায় দিতে এসে সান্ত্বনার বাণী ঝারছে, ‘ভালো থেকো। ঢাকায় পৌঁঁছে ফোন দিও।’ কেউ একজন উপদেশের সুরে অন্যজনকে বলছে, ‘শরীরের প্রতি যত্ন নিও। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি টার্মিনালের দিকে মুখ করা কেবিনে বসে গত রাতের কথা ভাবছি। মনের মধ্যে আসমার ছবি নিয়ে খেলা করছি।
আসমা আমার ফুফাতো বোন। গতকালই আমাদের বাড়িতে এসেছে। অনেকদিন পর দেখা। খুব ছোট সময়ে তাকে দেখেছি। পুচকে মেয়ে। গায়ে-গতরে গোশত ছিলো না তেমন, তবে বেজায় দুষ্টু ছিলো। আমাকে দেখলেই আঁচড় কাটতে চাইতো। আসমার এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ভরাট শরীর, তাতে বেশ কতক ভাঁজ। রাতের দিকে পুকুর ঘাটে বসে তার সাথে কথা হয়েছে। আসমাকে ছুঁতে ইচ্ছে করছিলো খুব। কিন্তু সে সাবধানে দূরত্ব বজায় রেখেছে। আমার ঔৎসুক্য দেখে আলতো হেসে বলেছে-
আমি এখন আর সেই পুচকে মেয়েটি নই আলেফ ভাই। ইচ্ছে করলেই তুমি আমাকে এখন আর ছুঁতে পারো না।
কেন পারি না, কৌতূহলী চোখ তুলে প্রশ্ন করেছি আমি। বলেছি, তুমি তো আমার সেই ফুফাতো বোনটিই আছো, নও কী?
আসমা আমার এ কথার কোনো জবাব দেয়নি। অবাক দৃষ্টিতে কতক্ষণ শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থেকেছে।
একসময় আমার মনে হলো আসমার চুল বাতাসে ভাসছে। সে নিজেও ভাসছে দূর আকাশে। হঠাৎই আমার কাছে আসমাকে মনে হলো পরীর দেশের মেয়ে। যেন পরীর দেশ থেকে এইমাত্র সে নেমে এসেছে। বসেছে আমার পাশে। মেয়েরা বড় হলে কি পরী হয়ে যায়? এমন সময় আমি টের পেলাম, আসমার শরীর থেকে বেলি ফুলের গন্ধ বেরোচ্ছে।
ভরা জোছনার রাত। জোছনার আলোয় পুকুরের জল রুপালি ইলিশের মতো ঝলমল করছিলো খুব। আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো জোছনার ওই ঝলমলে জলে আসমাকে নিয়ে সাঁতার কাটি। আমি একটু হাত বাড়াতেই আসমা কঠোর হয়ে উঠেছে। একসময় লক্ষ্য করলাম, তার চোখভর্তি জল। জোছনার আলোয় সে জল চিকচিক করছে!
আসমার ভেতরে বিশেষ কোনো দুঃখবোধ কী কাজ করছে? খুব জানতে ইচ্ছে হয়েছিলো। কিন্তু প্রশ্ন করার সাহস হয়নি বলেই কোনো কিছু জানা হয়ে ওঠেনি আর।
হকারের চিৎকারে ধ্যান ভাঙে একসময়। ‘গরম গরম খবর পড়েন স্যার, গরম গরম খবর।’ আমার খবরের কাগজ পড়তে ইচ্ছে হলো না। তবু একখানা খবরের কাগজ কিনলাম। কাগজের প্রথম পাতায় চোখ বোলালাম। রাজনীতিতে অনেক উটকো সময় আসে, আবার চলে যায়। শুনেছি একসময় এদেশে মশাল মার্কা রাজনীতির উৎপাত ছিলো খুব। কিন্তু এখন নেই। সময়ই সবকিছু ঠিক করে দেয়।
গত রাতে আসমাকে বলেছিলাম, ছোট থাকতে তুমি আমাকে আঁচড়ে দিতে চাইতে, মনে আছে?
খুব মনে আছে। তবে বড় হয়ে যে তোমাকে কামড়ে দিতে ইচ্ছে হতো, সেটি কিন্তু তুমি জানতে না আলেফ ভাই। এ কথা বলে আসমা এমনভাবে হাসতে থাকলো যে আমার গায়ের উপরই গড়িয়ে পড়ে।
আসমার কথা শুনে আমিও হাসলাম। বললাম, তাই নাকি? তাহলে এক্ষুণি কামড়ে দাও।
উঁহু, সেটি তো আর সম্ভব নয়। তুমি তো জানো, আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি এখন আরেকজনের স্ত্রী।
তাই তো। আসলেই আমি একটা বোকা। বিদেশে থেকে টাকা টাকা করে মাথাটা মোটা করে ফেলেছি।
একসময় আসমা মুখ বাড়িয়ে বলল, তোমাকে আমি অনেক খুঁজেছি আলেফ ভাই। আকাশে শুকতারা খুঁজে ফেরার মতো করে খুঁজেছি। সেই ছোট্ট সময়ে তোমাকে আঁচড়ে দেবার কথা মনে হতো বারবার। মনে হতো, বড় হয়েছি। আর ঠিক এ সময়ে যদি তোমাকে কামড়ে দিতে পারতাম, তবে কতই না মজা হতো। আসমা লম্বা করে হাঁক ঝারলো। বলল, বড় অসময়ে তোমার সাথে দেখা হলো আলেফ ভাই!
আবারও ভাবনায় ছেদ পড়লো। বিরাটাকায় মাছের শরীরের মতো লঞ্চটা নড়েচড়ে উঠলো। ভোঁ ভোঁ শব্দে ভ্যাপু বেজে চলেছে। ঠিক এ সময়ই হঠাৎ চোখে পড়লো টার্মিনালে দাঁড়ানো এক সুন্দরী রমনীর গাল বেয়ে টলটল করে জল গড়িয়ে পড়ছে। কোনো প্রিয়জনকে দূরদেশে বিদায় দিতে এসেই হয়তো বা তার এই কান্না। আমার ভ্রম হলো। আমি চিৎকার করে উঠলাম, আসমা…
লঞ্চ এগোতে থাকলো। এগোতে এগোতে চাঁদপুর বড় স্টেশনের মোড় পার হলো একসময়। আমার চোখের সামনে বিশাল মেঘনার অথৈ জল, যে জল বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। অসহায় আমি পেছনে তাকিয়ে দেখতে চাইলাম অন্য কোনো এক রমনীর জলছবি। কিন্তু সে ছবিও মিলিয়ে গেলো মেঘনার ঢেউতোলা জলে। বৈশাখের উথাল-পাথাল জলে।
Leave a Reply