বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩০ অপরাহ্ন

নায়করাজের প্রস্থান ও আমাদের সিনেমা

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৭
  • ৬৮৬ বার

রাজ্জাকের মৃত্যুর পর মানুষের শোক নতুন করে আশার আলো জাগায় যে একজন নিবেদিত প্রাণ চলচ্চিত্র কর্মীর জন্য এখনো এদেশের মানুষের ভালবাসা আছে। কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্র জগত যে একটি ক্ষুদ্র, পরিচিত এবং অভ্যস্ত বৃত্তের মধ্যে সীমিত হয়ে ক্রমেই লুপ্তপ্রায় সে জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার কোন বার্তা এই ভালবাসনা নয়। এই শ্রদ্ধা, এই প্রেম শুধুই ব্যক্তি নায়করাজের জন্য।

ক্ষুদ্র জগতের অবক্ষয় চলছে দীর্ঘ কাল যাবৎ। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এর উত্তরণ নিয়ে আপাতত কোন আশার আলো চোখে পড়ছেনা। মামুলি, তুচ্ছতাসর্বস্ব, অবিন্যস্ত আমাদের চলচ্চিত্রের বাজার। ‘আয়নাবাজি’র মতো দু’একটি ছবি হঠাৎ হঠাৎ আসা ছবি নাগরিক সমাজে কিছু আলোচনা জন্ম দেয় বটে, কিন্তু এগুলো এই শিল্পকে এগিয়ে নেয় না। এসব শহুরের ছবির দর্শক আলাদা। এসব তারা দেখেন যারা মূলত মাল্টিপ্লেক্সে যান।

 ‘বলা হয় চলচ্চিত্র এখন দাঁড়িয়ে নেই, একেবারে শুয়ে পড়েছে। এখন হিরো-হিরোইন উভয়ই প্রযোজক ধরে আনেন।’ 

বাণিজ্যিক ছবির মরা বাজারে সিঙ্গেল স্ক্রিন হলগুলোর অবস্থা সেখানে ক্রমেই পড়তি। সারা দেশে সিঙ্গেল স্ক্রিন হল- এর সংখ্যা কমছে আর কমছে। এফডিসিতে উৎপাদিত বাংলা ছবি চালিয়ে সেসব আর জিইয়ে রাখা যাচ্ছে না। ভাবা যায় কতটা উপায়হীন হলে হল মালিকরা বাঁচামরার হিসেব করছিলেন দু’একটি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার ছবি চালানোর মধ্য দিয়ে? ক্ষুদ্রতায় আক্রান্ত এই জগত তাও বন্ধ করতে সফল হয়েছে। পেশি শক্তির কাছে হার মানলো যখন সরকারের কাছেই কিছুটা অক্সিজেন চাচ্ছিলেন হলমালিকরা।

বস্তাপচা কাহিনী, দুর্বল নির্মাণ, সম্পাদনা সব মিলিয়ে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, অনেক দিন আগেই ‘ভদ্রলোক পাবলিক’ হলে যাওয়া ছেড়েছে। ফ্যামিলি নিয়ে কেউ আর যায় না সিনেমা দেখতে। ঘাম-চিটচিট শরীরে সিনেমা দেখবে মানুষ, এমন ভাবনাই এ শিল্পের কর্ণধারদের মনোজগতে। আসলে গোটা চলচ্চিত্র পাড়াটা পাকা-দাড়ি চুলকোনো আর খিস্তি খেউড় করা আজব শ্রেণিতে ভরে গেছে। শিল্প কাকে বলে, সিনেমা কাকে বলে এই উদ্ভট ভাবনার লোকগুলোই ঠিক করছে। তাই কোন সুস্থতা নেই কোথাও।

এই গাজাখুরি সিনেমা চালিয়ে চালিয়ে হলগুলোর ইমেজটাও হয়ে উঠেছে গাজা সেবনকারীদের হল হিসেবে। সময় এসেছে ভাবনার জগতে পরিবর্তন আনার। চলচ্চিত্র হলো একটি জাতির সৃজনশীল বহিঃপ্রকাশ। এখন যারা এফডিসিতে ছবি নির্মাণ করছে সেখানে সংস্কৃতি আছে কি না দেখতে হবে। বলা হয় ভাল গল্পের অভাব। কিন্তু গল্প আসবে কোথা থেকে? সংস্কৃতির চর্চা যারা করেন তাদের সঙ্গে ওঠাবসা নেই এফডিসির কেন্দ্রিক চক্রের। আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ওঠাবসা নেই প্রযুক্তির সাথেও।

বলা হয় চলচ্চিত্র এখন দাঁড়িয়ে নেই, একেবারে শুয়ে পড়েছে। এখন হিরো-হিরোইন উভয়ই প্রযোজক ধরে আনেন। প্রযোজক নিয়ে আসেন এবং প্রযোজক তার সম্পূর্ণ প্রভাব পরিচালকদের ওপর চাপান। প্রযোজক যাকে নিতে বলছে তাকেই নিতে হচ্ছে, ছবির ধরনও বলে দিচ্ছেন প্রযোজক।

প্রথম কাজ হল বাঁচানো। শুধু শুনতে হয় একের পর এক হল বন্ধের খবর।ঢালিউড বলা হয় ঢাকাই ফিল্ম জগতকে। কিন্তু সিনেমার ছিটেফোঁটাও নেই এখানে। আছে কেবল নোংরা রাজনীতি। কে কাকে বহিষ্কার করছে, কে কাকে হুমকি দিচ্ছে, এসব ছাড়া কোন গল্প নেই এই পাড়াটার। এটি এখনো পাড়া, সিনেমার জগত নয়। সেই পাড়ায় যে দু’একজন যোগ্য আছেন, প্রচেষ্টা হলো তাদের বেকায়দায় ফেলা, প্রয়োজনে ঝেটিয়ে বিদায় করা।

ঈদের ছুটি না-থাকলে কদাচিৎ লোকে ছবি দেখতে আসে। একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়া কোন সুস্থতার লক্ষণ নয়। প্রযুক্তির প্রসার ও উপযুক্ত ব্যবহার বাংলা সিনেমায় কেউ কি দেখছে? যেসব প্রিন্টের ছবি এদেশের দর্শকদের দেখানো হয় সেগুলোকে নোংরা লাগে এযুগের ঝাঁ-চকচকে সিনেমার ডিজিটাল প্রিন্টের সাথে তুলনা করলে।

বিদেশের বাজারতো অনেক দূরের ব্যাপার, দেশের বাজারেই ‘প্রোডাক্ট’ হিসেবে এফডিসি’র সিনেমা এখনো সেই ঘুলিঘুপচির জায়গাতেই পড়ে রয়েছে। অথচ পাশের পশ্চিমবঙ্গের টালিঞ্জের ছবি লাফিয়ে লাফিয়ে কয়েকশো গুণ এগিয়ে গেছে। তফাতটা শুধুই অর্থনৈতিক নয়। অনেক বেশি শিক্ষা আর রুচির।

ভাল ছায়াছবির চাহিদা দিন কে দিন বাড়ছে। আমরাই জোগান দিতে বিমুখ। প্রত্যক্ষ ক্ষতি হলো হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পরোক্ষ ক্ষতিও কম নেই। যারা ভাল পরিচালক আছেন, যারা মান সম্মত কিছু করতে চান, তারা আর প্রবেশাধিকার পান না এই যখন তখন হুমকি দাতাদের রাজনীতির কারণে। প্রতিদিন অনেক সম্ভাবনাকে গলা টিপে ধরছে এই অপশক্তি।

ছোট পুকুর থেকে বড় পুকুরে পৌঁছতে না-পারলে বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সবার ভাললাগার মতো ছবি তো চাই। সঙ্গে পুরনো সিনেমা হলের স্বাস্থ্য না-ফেরালে শিল্প বাঁচবে কি করে? সময় এসে গেছে বদলে যাবার। সিনেমা কাকে বলে ঠিক করবে কে? মানুষ। যুগে যুগে শিল্প ভাল না মন্দ ঠিক করেছে কে? পাবলিক।

জনগোষ্ঠিই শিল্পের সবচেয়ে বড় বিচারক। সিনেমা মানুষের। সিনেমার উৎসব মানুষের, অসাংস্কৃতিক গোষ্ঠির নয়। আমাদের চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এ জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা বড় ভূমিকা আছে। কিন্তু বাণিজ্যিকীকরণ, সুস্থ ও রুচিশীল বিনিয়োগ এখানে আনতে না পারলে চলচ্চিত্র কখনো সেই মানুষের হবেনা।

রাজ্জাকের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে যদি সুবিধাভোগীদের কবল থেকে বের করে আনা যায় আমাদের সিনেমাকে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..