ছুটিতে থাকা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার বিরুদ্ধে ওঠা নৈতিক স্খলনসহ ১১টি অভিযোগের অনুসন্ধান করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব অভিযোগের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ফিরতে পারছেন না বলেও মনে করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
রোববার সচিবালয়ে সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী এ কথা জানান।
গত শুক্রবার রাতে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা অস্ট্রেলিয়া গেছেন। যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের কাছে একটি বিবৃতিও দিয়েছেন তিনি। এর পরের দিনই তার বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলন, অনিয়ম-দুর্নীতিসহ ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সম্বলিত দালিলিক তথ্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের কাছে হস্তান্তর করেছেন বলে সুপ্রিম কোর্ট এক বিবৃতিতে জানান।
প্রধান বিচারপতির অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘যদি কারও বিরুদ্ধে কমপ্লেইন হয় মামলা-মোকদ্দমার আগে এটার একটা প্রসেস আছে। এলিগেশন উঠেছে, আইন নিজস্ব গতিতে চলবে। এলিগেশন যেহেতু উঠেছে। যেভাবে অনুসন্ধান করতে হয় সেটা হবে। অনুসন্ধানের পর যদি সত্যতা পাওয়া যায় তবে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। কেউ কিন্তু আইনের ঊর্ধ্বে নয়, আইনে যা বলা আছে সকলের ব্যাপারে তা পালন করা হবে।’
প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আইনি পদক্ষেপ কী হবে? জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা জানেন দুর্নীতির অভিযোগ কে করে। আমাকে কি বলে দিতে হবে যে অ্যান্টি করাপশন কমিশন-২০০৪ সালের আইনে একটি ইন্ডিপেনডেন্ট অ্যান্টি করাপশন কমিশন আছে। এটা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ব্যাপার বলে আমার মনে হয় না।’
এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নেই, সংসদের ক্ষমতা নেই, এই অবস্থায় একজন বিচারপতির অভিযোগের তদন্ত কীভাবে হবে? এ বিষয়ে আনিসুল হক বলেন, ‘এখানে একটা ভ্যাকিউম (শূন্যতা) আছে। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতির কিছু ক্ষমতা আছে, সেটা তিনি ব্যবহার করতে পারেন। এই এলিগেশনগুলোর অনুসন্ধান হতে হবে, যদি অনুসন্ধান হয়, সেখানে সত্যতা পাওয়া যায় তখন মামলা হবে। মামলার পর তদন্ত হবে। তখন প্রশ্ন আসবে মাননীয় প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, এর সবগুলোই দুর্নীতি দমন কমিশনের আওতায় তাহলে আপনারা বুঝতেই পারছেন কে অনুসন্ধান করবে।’
‘কোনো অভিযোগের অনুসন্ধান দুদক নিজেও করতে পারে বা কেউ তাদের কাছে পাঠাতে পারে।’
দুদকে অনুসন্ধানের জন্য আপনারা পাঠাবেন কি না? এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘সেটার ব্যাপারে বিবেচনা করব।’
তিনি (প্রধান বিচারপতি) বিদেশ যাওয়ার একদিন পর এ অভিযোগগুলো ওঠায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তিনি (প্রধান বিচারপিত) তো কথা বলার সুযোগ পেলেন না- এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট যে বিবৃতি দিয়েছে তা তো আমার নিয়ন্ত্রণে নয়। এ ব্যাপারে আমি বিশেষ কথা বলতে চাই না।’
এই অভিযোগের পর এসকে সিনহা প্রধান চারপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করতে পারবেন কি না? জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, ‘আমার সামনে যে তথ্য রয়েছে তার ওপর নির্ভর করে বলছি….। যতক্ষণ পর্যন্ত না এই ১১টি এলিগেশনের ব্যাপারে সুরাহা না হবে তারা (আপিল বিভাগের বিচারপতি) হয়ত তার (প্রধান বিচারপতি) সঙ্গে বসবেন না। তাহলে তিনি কী করে এখানে এসে বসবেন। আপিল বিভাগে একক বেঞ্চের কোনো নিয়ম আছে বলে আমার জানা নেই।’
১১টি অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি জানেন, তারপরও প্রধান বিচারপতিকে বিদেশে যেতে দেয়া হলো কীভাবে? একজন সাংবাদিক জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘তিনি এখনও বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি আছেন। উনি ছুটি নিয়েছেন, নিজে স্বীকার করেছেন যে ১০ তারিখের মধ্যে আসবেন। বিচারপতির আসনটা একটা প্রতিষ্ঠান। এই আসনটা যিনি অলঙ্কৃত করবেন তাকে যদি অভিযুক্ত করতে হয়, ব্যবস্থা নিতে হয় তবে সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। খামখেয়ালিভাবে তাড়াহুড়া করে প্রধান বিচারপতির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া আমরা মনে করি সমীচীন নয়।’
সুপ্রিম কোর্টের এভাবে বিবৃতি দেয়া ঠিক হয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা ওনাদের জিজ্ঞাসা করুন।’
আপিল বিভাগের বিচারপতিরা প্রধান বিচারপতির কাছে অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইতে পারেন কি না- এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘তারা তার সঙ্গে বসেন। তাদের রিলেশনশিপ আলাদা। যখন রাষ্ট্রপতি অভিযোগগুলো দিয়েছেন, তারা জেনেছেন। সেভাবে ইনারনালি তাকে (প্রধান বিচারপতি) গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন ও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ বিষয়ে তো আমাদের কিছু বলার নেই।’
প্রধান বিচারপতির বক্তব্য আইন সঙ্গত নয়
শুক্রবার রাতে এসকে সিনহা অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের কাছে সরবরাহ করা বিবৃতিতে বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনরত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রবীণতম বিচারপতির উদ্ধৃতি দিয়ে মাননীয় আইনমন্ত্রী প্রকাশ করেছেন যে, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অচিরেই সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনে পরিবর্তন আনবেন। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো রেওয়াজ নেই।’
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি যে কাজ করতে পারেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ঠিক সেই একই কাজ করতে পারেন। সেটাই সংবিধানে (৯৭ অনুচ্ছেদে) বলা আছে। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমার বলতে হয়- মাননীয় প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটা আইন সঙ্গত নয়।’
এসকে সিনহার বিবৃতির বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি যখন (বিদেশ যেতে) বাসস্থান ত্যাগ করেছেন তখন কাউকে অ্যাড্রেস না করে একটি লিখিত জিনিস দিয়েছেন। তিনি সেখানে বলেছেন তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। আমি তার এই বক্তব্যে নিশ্চয়ই হতভম্ব। এর কারণ হচ্ছে দেশের প্রধান বিচারপতি মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে নিজ হস্তে সই করে চিঠি লিখেছেন, কী লিখেছেন তা আমি আপনাদের পড়ে শুনিয়েছি। তিনি যে অসুস্থ সেই কথা বলেছেন। আবার সাততিন পর তিনি বলছেন তিনি সুস্থ।’
‘ওই সময় হয়তো ডাক্তারি পরীক্ষা করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা যখন হয়নি তাই আমি আর এটা বাড়াতে চাই না।’
এসকে সিনহা মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির ছুটির দরখাস্ত নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, তার অসুস্থতা নিয়েও অনেকে অনেক কথা বলছেন।’
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে আইনমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা প্রধান বিচারপতি সিনহার ছুটির চিঠিটি সাংবাদিকদের পড়ে শোনান। একই সঙ্গে এ বিষয়ে আইন ও বিচার বিভাগের সচিবের কাছে লেখা সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল জাকির হোসেনের চিঠি পড়ে শোনান।
রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে এসকে সিনহার বিদেশ সফর নিয়ে তার একান্ত সচিব আনিসুর রহমানের লেখা চিঠিটিও পড়ে শোনান আইনমন্ত্রী। ওই চিঠিতে একান্ত সচিব লিখেছেন, ‘প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা মহোদয় দীর্ঘদিন বিচারকাজে থাকায় এবং অবসর গ্রহণের তারিখ নিকটবর্তী হওয়ায় মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত মর্মে অবগত করেছেন। মানসিক অবসাদ দূর করার জন্য তিনি আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য গমন ও অবস্থানের মনস্থির করেছেন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে প্রধান বিচারপতি বাচনিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন।’
এ বিষয়ে আইন ও বিচার বিভাগের সচিবের কাছে লেখা সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল জাকির হোসেনের ফরোয়ার্ডিং চিঠিটিও পড়েন মন্ত্রী। মন্ত্রী বলেন, ‘এই দুটি চিঠির প্রেক্ষিতে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। এর বিষয়ে জিও (সরকারি আদেশ জারি) করা হয়েছে।’
ষড়যন্ত্র হাসিল হয়নি বলেই তাদের মায়াকান্না
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমার মনে হয় এ নিয়ে (প্রধান বিচারপতির ছুটি) কোনো বিতর্ক সৃষ্টির কারণ ছিল না। কিছু কিছু রাজনৈতিক মহল কোনো ইস্যু না থাকার কারণে খড়কুটো দিয়ে ইস্যু তৈরি করার অভিপ্রায়ে এটাকে একটা বিচার ইস্যু করার চেষ্টা করছে।’
তিনি বলেন, ‘যারা এটা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করছেন তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হাসিল হয়নি বলেই তাদের এই মায়াকান্না।’
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতার কথা বলে গত ৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত এক মাসের ছুটি নেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা।
গত মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো অপর চিঠিতে এসকে সিনহা জানান, তিনি ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশে অবস্থান করতে চান।
পরে বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) আইন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আগামী ১০ নভেম্বর পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিদেশে অবস্থানকালীন বা তার কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করবেন বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা।
Leave a Reply